





গুপ্তধনের কথা শুনলেই মনে যে দৃশ্যটা সাথে সাথে ফুটে উঠে, তাহলো বিখ্যাত আলী বাবা চল্লিশ চোরের ঘটনা। আরব্য রজনীর





সেই হাজার রাতের কাহিনী, গরীব আলী বাবা গুপ্তধন পেল, সে কথা কাশেম জেনে গেল। আলীর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে





সে গেল গুপ্তধন আনতে। কিন্তু অতি লোভ করার ফলে ডাকাতের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারাল। আলী গিয়ে গুহা থেকে





ভাইয়ের লাশ নিয়ে আসায় ডাকাতরা তাকে চিনে ফেলে, এবং মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু মর্জিনা





সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ডাকাতদের হত্যা করে, আলী বিপদ মুক্ত হয়। ফলে খুশী হয়ে সে কাশেমের ছেলের সাথে মর্জিনার বিবাহ দেয় এবং





সব ধনের একা মালিক হয়। এভাবে দরিদ্র আলী বাবা বাগাদাদের সেরা ধনীতে পরিণত হল। কিচ্ছাগুলা তখন এমন হত, গরীবকে ধনী বানিয়ে দিত, ধনীকে মেরে ফেলত, গরীবরা সুখে-শান্তিতে দিন কাটাত। আসলে তখন কবি-সাহিত্যিকগণ দরিদ্র ছিলেন, তাই ভিখারী আলীকে ধনী বানালেন, কাশেমকে লোভী ও মন্দ সাজালেন।
সম্ভবত গরীব হওয়ায় তাঁরা ধনীদের অপছন্দ করতেন। সঞ্চিতের বিরুদ্ধে বঞ্চিতের সংগ্রাম। কার্ল মার্ক্সের কালজয়ী শ্রেণী সংগ্রাম যুগে যুগে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের হাতিয়ার। পুরনো গল্পগুলোতে দেখবেন, গুপ্তধন খালি গরীবরা পেত, জলপরী সোনার কুঠার কেবল কাঠুরিয়াকে এনে দিত। জনম দুখী জেলে পেত যাদুর বাটি যার কাছে যা চাইত তা পেত।
ঠিক সেই একই কাÐটি ঘটেছে এখন এসে রাজশাহীর বাগমারাতে। মাটির নীচে গুপ্তধন পেয়ে নিয়ে চলে গেলমজুররা আর জায়গার মালিক গিয়ে থানায় করে দিল মামলা, হা হা..। খবরে প্রকাশ বাগমারায় এক ব্যক্তির জায়গা খনন করা হচ্ছিল, কিছু দূর খুঁড়ে কলস সদৃশ একটি কিছু পেয়ে তিন মজুর মিলে গোপনে নিয়ে গিয়ে আর কাজে এলনা।
কাজেই জায়গার মালিক বুঝে গেলেন ঘটনা সত্যি জিনিস পাওয়া গেছে, ফলে থানায় জানিয়ে দিলেন। পুলিশ সেই মজুরদের খুঁজছে পেয়েছে কিনা জানিনা, তবে এটি বুঝতে পারছি মালিকের অন্তর হয়ে যাচ্ছে ফানা। গুপ্তধন- যে সেই কথা, ‘হাত ম্যা আয়া মু ম্যা নালাগা’র মত। চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল যক্ষের ধন, কিছুই করতে পারলনা। এই জ্বালা কি আর প্রাণে সয়? আমার মনে দিয়ে জ্বালা আমার ধন নিয়ে গেলম জদুর শালা, পেলে তোদের করব আমি ফালা ফালা।
সেই চেতনা থেকে মালিক থানায় করলেন নালিশ কিন্তু নিজেই পেতেন যদি ঘুমাতেন সুখে মাথায় দিয়ে বালিশ। ঠিক আছে তার জায়গায় পাওয়া ধন, মালিক তিনি, কিন্তু খুয়া যাওয়ার পেছনে তো পুরা দোষ তার। খুঁড়তে দিয়ে তিনি পাশে ছিলেন না, ভেবেছিলেন বসে থেকে কি করব? তাদের কাজ তারা করুক আমারটা আমি, এখন খবর শুনে মাথায় পড়ল ঠাটা, হা হা হা হা।
এক সময় ওসব বেশি পাওয়া যেত, তাই জায়গার মালিক যতক্ষণ মাটি কাটা কিংবা পুকুর খনন শেষ না হয় মজুরদের সাথে লেগে থাকতেন। এভাবে বিভিন্ন সময় অনেকে সোনার কলস, গুপ্তধন পেয়েছে বলে জানি। শুনেছি এদেশে মগদের কাছে নাকি ওসব স্বর্ণালঙ্কার ও সোনার মোহর প্রচুর ছিল। অবশ্য থাকারও কথা, কারণ তারা তো ডাকাত ছিল।
ফলে দেশের সাধারণ বাসিন্দাদের কাছ থেকে সেসব ডাকাতি করে তারা নিজেদের কাছে জমাত আলী বাবার চল্লিশ চোরের মত। মোগল ও ইংরেজ শাসকরা যখন ঐ সব মগ আর বর্গীদের এদেশ থেকে তাড়াতে শুরু করলেন, তারা তখন তাদের সে সম্পদ মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে রেখেছে এবং সেই জায়গার একটি নক্শা তৈরী করে সাথে নিয়ে গেছে, যেন পরে এসে নক্শা ধরে সেসব বের করে নিয়ে যেতে পারে।
অনেকে নাকি পরে এসে তাদের সম্পদ সেভাবে নিয়েও গিয়েছিল। অনেক দিন আগে শুনে ছিলাম কোন এক গ্রামে এক বাড়ীর লোকেরা সকালে উঠে দেখে তাদের পুকুরের ওপাড়ে বড় একটি গর্ত। সবাই তো বিস্মিত, কাল বিকেলেও তো ছিলনা, রাতে রাতে গর্তটি করল কারা এবং কেন? এখন জায়গাটি হলো পাহাড়ি এলাকায়, লোকে বলাবলি করছে নিশ্চয় গুপ্তধন ছিল।
যারা রেখে গিয়েছিল নক্শা ধরে নিশ্চয় তারা কিংবা তাদের বংশধররা এসে নিয়ে গেছে। এ গুঞ্জন শুনে বাড়ির কর্তা বুকে চাপড় মেরে চিৎকার দিয়ে; মারে কাঙ্গাল বানাই দিলরেÑবলেই জ্ঞান হারা, হা হা হা। আসলে গুপ্তধন বড় লোভনীয় বস্তু, এই যে লোকটা, ধন তার ছিলই না, খুয়া যাওয়ায় তার দু’পয়সার ক্ষতিও হয়নি। তথাপি সে বেহুঁশ হয়ে গেল, কারণ কল্পনায় সে বিশাল রাজ্য তৈরী করে ফেলেছে।
তারপর বাস্তবের ঝটকায় এমন খটকা লাগল সইতে পারলনা। বাগ মারার সেই জায়গার মালিকেরও নিশ্চয় তেমনই ঝটকা লেগেছে, তার হৃদয়টা ভেঙ্গে গেছে। আহামজুর রাতার সাথে বড় বেইমানি করেছে, তাকে না জানিয়ে গোটা মোহর ভর্তি কলস নিয়ে গেল? কিন্তু মজদুররা তা পারল কেমনে? কলসে তো সাপ থাকার কথা, সে সাপ সরিয়ে কলস নিয়ে যাওয়া তো এত সহজ না।
যারা কলসগুলো গেড়েছিল তারা নাকি অতি জটিল মগামন্ত্র জপ করে সেগুলো গেড়েছিল। যাতে কেউ সেগুলা খুঁজে না পায়, আর পেলেও যেন নিতে না পারে তাই মন্ত্রের জোরে সাপ এসে সেগুলাকে পাহারা দেয়। এজন্য এ ধনকে যক্ষের ধন বলে এবং সাপই হচ্ছে যক্ষ। দুটি সাপ কলসির গলা প্যাঁচিয়ে সব সময় এ ধন পাহারা দেয়, তাই কলসি সরানো অতি কঠিন।
এটিই আমরা পদ্মগোখরোতে দেখেছি, আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত ছোট গল্প। জোহরা শ্বশুর বাড়িতে গুপ্তধন পেল, কলসির মাথায় দুটি পদ্মগোখরো তা পাহারা দিচ্ছে। জোহরা দ্রæত এক বাটি দুধ এনে কলসির অদূরে রাখতেই সাপ দুটি নেমে এসে দুধ খেতে লাগল জোহরা সেই ফাঁকে কলসটি সরিয়ে নিল, মির সাহেবরা ধনী হয়ে গেল। কিন্তু এ সিস্টেম তোমজুরদের জানার কথা না, তারা কেমনে কলস সরাল?
সাপগুলো জোহরার পাশে পাশেই থাকত, ফলে তার স্বামী আরিফ ও শ্বশুর-শাশুড়ি ভয় পেতেন তাই একদিন তাঁরা জোহরাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। অনেক দিন পর আরিফ শ্বশুর বাড়ি গেল, একদিন রাতে দেখে শ্বশুর সৈয়দ সাহেব ও শাশুড়ি মিলে জোহরার অলংকারগুলি চুরি করে ফেলেন। চুরির কথা আরিফ জানে দেখে সৈয়দ সাহেব আর তাঁর স্ত্রী মিলে খানার ভেতর তাকে বিষ খাওয়ান। সে অনেক কথা শেষে আরিফ বাঁচে, সৈয়দ স্ত্রীকে নিয়ে হজ্বে রওনা হলেন।
পথে স্ত্রী কলেরায় মারা গেলেন, একদিন সন্ধ্যায় সৈয়দ লুকিয়ে মির বাড়ি জোহরাকে দেখতে এসে পদ্মগোখরো দুটির কামড়ে মারা গেলেন। মরার আগে তিনিও সাপ দুটিকে লাঠি দিয়ে মেরে ফেললেন। পরদিন গ্রামময় রাষ্ট্র হল মির সাহেবদের বউ এক জোড়া মরা সাপ প্রসব করে মারা গিয়েছে। বাগমারায় এমন কিছু দেখিনি, কলসে সাপের কথা শুনিনি। কিন্তু সাপ গেল কোথায়, আচ্ছা মন্ত্রের টেম্পার কোন চলে গেল নাকি? এক্সপায়েরি ডেট খতম হয়ে গেছে আরকি, হি হি হি হি।
বিভিন্ন দ্রব্যের গায়ে মেয়াদ থাকে না, ডেট শেষ হলে গুণ শেষ? ঠিক তেমন মন্ত্রের ডেটও মনে হয় এক্সপায়ার হয়ে গেছে তাই কলসিতে সাপ নাই। অবশ্য তা হওয়ারও কথা, অনেক বছর তোÑ ৩/৪শ বছর তো হবে। অত বছর কি আর টাইম থাকে? অতএব সেই সুযোগে মজদুররা কলসি নিয়ে লাপাত্তা, হা হা হা হা। অনুরূপ আমরা সোলায়মানের (আঃ) কলসির কথাও জানি, দুষ্টু জ্বীনদের তিনি কলস ভরে মোহর মেরে সাগরে ফেলে দিয়েছেন তিন/চার হাজার বছরের মেয়াদে।
এখন ডেট ওভার হয়ে যাওয়ায় তারা একে একে বেরিয়ে আসছে তাই ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, সাইক্লোন হয়। অনেকে আবার মেয়াদ ফুরানোর আগেও বের হয়ে গেছে। নদীতে জাল ফেলতে গিয়ে অনেক সময় জেলেদের জালে লেগে কলসগুলো উঠে আসে। জেলেরা না বুঝে কলসির মোহরটা খুলে ফেলে, ফলে মেয়াদের আগে জ্বীনেরা মুক্তি পেয়ে যায়।
তার খুশীতে কেউ জেলেদের পুরস্কৃত করে, কেউ আবার রেগে গিয়ে জেলেদের হত্যা করে। এখন তারা রেগে কেন যায়, কেন জেলেদের হত্যা করে? হতে পারে শোষকের উপর শোষিতের প্রতিশোধ। মানব কর্তৃক বন্দি হওয়ায় তাদের প্রতিবাদ, মানবের উপর দানবের ঈর্ষা। অনুরূপ বাগমারার মালিকের উপর ও মজুরদের বঞ্চনার ঈর্ষা, হা হা..। প্রবন্ধের প্রতিটি কাহিনীতে লোভ মিশে আছে। আসলে মানুষ বড় লোভী, এটি ত্যাগ করতে পারলে ঈর্ষা ভরসায় রূপ নেবে, ধন্যবাদ।
ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন…
Leave a Reply